• বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ২ ১৪৩১

  • || ০৭ জ্বিলকদ ১৪৪৫

‘প্রিয় শিক্ষক’ শফিয়ার রহমান 

প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২২  

ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যেকের জীবনে শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মধ্যে ভালোলাগার কিছু শিক্ষক থাকেন, যাদের দিকনির্দেশনা, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, স্নেহ-ভালোবাসা মনে আলাদা করে দাগ কাটে। তাদের বলা হয়ে থাকে ‘প্রিয় শিক্ষক’। দেশজুড়ে থাকা এমন অনেক শিক্ষকের মধ্যে একজন শফিয়ার রহমান।

ষাটোর্ধ্ব শফিয়ার রহমান শুধু শিক্ষকই নন, তিনি একজন দক্ষ সংগঠক, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী। তাই চাকরি থেকে অবসর নিলেও কাজ থেকে অবসর নেননি তিনি। এখনো শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নানামুখী কাজ করছেন। আর্থিক সংকটে শিক্ষার্থীরা যেন ঝরে না পড়ে, তাই তাদের বাড়িতে এনে নিজ দায়িত্বে পড়াশোনা করান তিনি। এর পাশাপাশি অসহায় পরিবারের শিক্ষার্থীদের আপদ-বিপদেও পাশে দাঁড়ান।

সদ্য অবসরে গেছেন শিক্ষক শফিয়ার রহমান। তিনি রংপুর জিলা স্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। অবসর শব্দটি চাকরি থেকে মিললেও তার জীবনের অংকে অবসরের কোনো ছক নেই। এখনো সময় পেলেই ছুটে যান প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে। খোঁজখবর নেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের নিয়ে খোশগল্পে মেতে ওঠেন। খেলাধুলা, বিতর্ক, আবৃত্তিসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়াতে তাদের উদ্বুদ্ধ করেন। বাঙালির প্রাণের উৎসবগুলোতে তার সরব উপস্থিতি এবং মনোমুগ্ধকর লাঠিখেলা এখনো মন কাড়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। 

শফিয়ার রহমান রংপুর জিলা স্কুলে প্রায় ১৮ বছর শিক্ষকতা করেছেন। এ সময় শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করা বা বৃক্ষরোপণের মতো কাজে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে বইয়ের পাতার বাইরে বাস্তব জগতের সঙ্গে অসাধারণভাবে পরিচয় করিয়ে দেন এই শিক্ষক। গণিত উৎসব, ভাষা প্রতিযোগ, বিজ্ঞান উৎসবসহ বিভিন্ন ভালো কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেন। শিক্ষকতার এমন পরিপূর্ণ উদাহরণ স্থাপন করে শফিয়ার রহমান হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীদের ‘প্রিয় শিক্ষক’। 

ছোটবেলায় তিস্তা নদীর পাড় থেকে নদীভাঙন ও বন্যাকবলিত মানুষের দুঃখ খুব কাছ থেকে দেখেছেন শফিয়ার রহমান। অসহায় মানুষের কষ্টকে কাছ থেকে উপলব্ধি করার কারণেই হয়তো অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মাঝে জেগে ওঠে। অদম্য অসহায় শিক্ষার্থীরা যাতে দারিদ্র্যের কাছে হার মেনে ঝরে না পড়ে, এজন্য শিক্ষক হিসেবে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তার নানা উদ্যোগের কথা লোকমুখে শোনা যায়। তিনি নানামুখী কর্মকাণ্ডের জন্য ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা-২০২১’ পেয়েছেন। 

রংপুর জিলা স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটা সময় স্কুলের বিশাল এলাকাজুড়ে ছিল ঝোপঝাড়। সেগুলো পরিষ্কার করে শফিয়ার রহমান নানা জাতের গাছের চারা রোপণ করেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে খরা মৌসুমে তিনি পানি দেওয়াসহ গাছের পরিচর্যা করতেন। এতে বিভিন্ন সময়ে তাকে কটু কথাও শুনতে হয়েছে। এরপরও তিনি থেমে যাননি। বরং দিনে দিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা আরও মজবুত হয়ে ওঠে।

জিলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সনেট, ওসমান, নবীন ও সুব্রত বলেন, জিলা স্কুলে থাকা অবস্থায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন আয়োজনে শফিয়ার স্যারের চেষ্টা ছিল মনে রাখার মতো। বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বটতলা সাজানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকতেন। তিনি নিজে লাঠিখেলাও দেখাতেন। শফিয়ার স্যার ছিলেন আমাদের সবার প্রিয়। 

জানা গেছে, শফিয়ার রহমানের স্কুলজীবন কেটেছে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দক্ষিণ পারুলিয়ার পারুলিয়া তফসিলি দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর রংপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে। স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তর করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। 

এরপর রংপুর আইন কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন। একই সঙ্গে রংপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে এমএড ডিগ্রি লাভ করেন। চাকরিজীবনের শুরুতে চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরি করেন। বর্তমানে রংপুর মহানগরীর কেরানীপাড়ায় পরিবারসহ বসবাস করছেন শফিয়ার রহমান। তার এক ছেলে চাকরি করছেন। মেয়ে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন। স্ত্রী সেতারা আক্তার পারভীন গৃহিণী।

শফিয়ার রহমান জানান, শিক্ষার্থীদের জন্য সারাজীবন কাজ করে যেতে চান তিনি। কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়া মানে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়া নয়। তাই সব সময় শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে চান। এখনো শত ব্যবস্তার মধ্যেও তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য একটা সময় বরাদ্দ করে রাখেন। 

তিনি বলেন, ছোটবেলায় তিস্তা নদীর পাড় থেকে নদীভাঙন ও বন্যাকবলিত মানুষের দুঃখ দুর্দশা খুব কাছ থেকে দেখেছি। এখনো চোখের সামনে এসব ভেসে আসে। আমি চেষ্টা করছি অদম্য অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে সাহস দেওয়ার। তাদেরকে ভালো কাজগুলোতে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছি। আমাদের শিক্ষার্থী অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে হবে, আমার কাজের মাধ্যমে তাদের মধ্যে সেই চেতনা ছড়িয়ে দিতে চাই।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, শফিয়ার রহমান শুধু শিক্ষক হিসেবে পরিচিত নন, সামাজিক আন্দোলনের অগ্রসৈনিক হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। বর্তমানে তিনি ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি এখনো নিবেদিত হয়ে কাজ করছেন।
তথ্যসূত্র- ঢাকা পোস্ট

– দিনাজপুর দর্পণ নিউজ ডেস্ক –